পরের সংবাদ»
শিশু জিহাদকে উদ্ধারে দীর্ঘ প্রায় ২৩ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযানের ইতি টেনে যখন হাল ছেড়ে দেয় রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান। তখন সবাইকে অবাক করে রাষ্ট্রীয় সামর্থ্যকে তুচ্ছ করে ত্রাতা হয়ে ওঠেন স্থানীয় উদ্ধারকারীরা। সরকারি সংস্থার সব কর্মীদের বোকা বানিয়ে তারাই হয়ে ওঠেন জিহাদ উদ্ধার অভিযানের নায়ক। এ অভিযান ঘিরে আগের দিন বাতাসে ছড়ায় নানা প্রশ্ন।
খোদ সরকারি সংস্থার কর্তাব্যক্তিরাই ঘটনাস্থলে প্রশ্ন তুলেছিলেন পাইপে জিহাদের পড়ে যাওয়া নিয়ে। গতকাল সকাল থেকে এসব প্রশ্ন আরও ডালপালা মেলে। দুপুরের পর যখন জিহাদের নিথর দেহ পাইপ থেকেই উদ্ধার হয় তখন উদ্ধার অভিযান ঘিরে থাকা নানা প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা রূপ নেয় বিক্ষোভে। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের পদত্যাগ ও শাস্তি দাবি করে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেন। সন্তানকে জীবিত ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে থাকা পরিবারেও তখন শোকের মাতম। দিনভর পুলিশের হেফাজতে থাকা পরিবারের সদস্যরা যখন বাসায় ফেরেন তখন তাদের কান্নার সঙ্গে ক্ষোভের আওয়াজ। জিহাদের পিতা নাসির ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, রাতে তার ছেলেকে উদ্ধার করলে হয়তো জীবিতই পাওয়া যেতো তাকে। আর রাষ্ট্রীয় সংস্থার গাফিলতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।
শুক্রবার রাতভর অভিযান চালিয়ে ভোররাতে যখন উদ্ধারকর্মীরা জানায়, পাইপে কোন মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি তখন চারপাশে গুজব ছড়ায় পাইপের গভীরে শিশুটির পড়ে যাওয়া পুরোটাই ‘নাটক’। সন্দেহ শুরু হয় আসলেই পাইপের ভেতরে শিশুটি আদৌ আছে কিনা। রাতেই শিশু জিহাদের পিতা ও দুই প্রত্যক্ষদর্শীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায় পুলিশ। রাত পেরিয়ে দিন শুরু হলে গুজব আরও বাড়তে থাকে। দুপুরে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। বেলা তখন আড়াইটা। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ সাড়ে ২৩ ঘণ্টা। এর কিছুক্ষণ পরই স্থানীয়দের প্রয়োগ করা পদ্ধতির মাধ্যমে উঠে আসে শিশু জিহাদের লাশ। ভেজা শরীর। মাথা ও মুখম-লে বালু আর সুতো জড়ানো। পরনে সেই হলুদ জামা। উদ্ধারকর্মীরা তাকে নিয়ে ছুটছে বাইরে। একটি গাড়িতে তুলে শিশুটিকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানান, কয়েক ঘণ্টা আগেই মারা গেছে শিশুটি।
শুক্রবার বিকাল ৩টার দিকে খেলতে গিয়ে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির পরিত্যক্ত একটি গভীর নলকূপের পাইপের ভেতরে পড়ে যায় চার বছরের শিশু জিহাদ। প্রথমে জিহাদের খেলার সঙ্গী সিয়াম বিষয়টি অন্যদের জানায়। ওই কূপের পাশেই ব্যাডমিন্টন খেলছিল ফাতেমা নামে এক কিশোরী। উড়ে যাওয়া কর্ক আনতে গিয়ে সে-ও শুনতে পায় পাইপের ভেতর থেকে আসছে কান্নার শব্দ। বিষয়টি সে-ও স্থানীয় সবাইকে জানায়। স্থানীয়রা প্রথমে লম্বা দড়ি ফেলে তুলে আনার চেষ্টা করে শিশু জিহাদকে। খবর পেয়ে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের একাধিক দল। শুরু হয় উদ্ধার অভিযান।
ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযানের প্রথমে দড়ির সঙ্গে বস্তা বেঁধে নিচে নামিয়ে দেন। তারপর ফেলা হয় টর্চ লাইট। কেউ কেউ বলতে থাকেন ভেতর থেকে জিহাদের কান্নার শব্দ এসেছে। পাইপের ভেতরে দড়ি দিয়ে পাঠানো হয় জুস। দেয়া হয় অক্সিজেন। পাঠানো হয় একাধিক ক্যামেরা। ১৭ থেকে ১৮ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাইপের ভেতরে ছিল আরেকটি সরু পাইপ। রাতেই ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা শুরু হয় ওই পাইপ। প্রায় ৩০ ফুট করে তোলার পর কেটে ফেলা হচ্ছিল সেটি। এক পর্যায়ে পুরোটাই তুলে ফেলা হয়। এর শেষ অংশে ছিল ফিল্টার এবং সাবমার্সিবল পাম্প। এরপর সেখানে নামানো হয় ওয়াসার বিশেষ প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্যামেরা। মাটির নিচের ছবি তোলার জন্য কেনা এই ক্যামেরা ব্যবহার উপযোগী করতে সময় লেগে যায় প্রায় এক ঘণ্টা। এটি যখন সচল হয় তখন ওয়াসার কর্মকর্তা এবং উপস্থিত উদ্ধারকর্মীরাই পর্যালোচনা করছিলেন ভেতরের ছবি। সেই ক্যামেরাতেও জিহাদের ছবি ধরা পড়েনি। দেখা যায় ব্যাঙ ও কিছু আবর্জনার ছবি। রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। উদ্ধার তৎপরতা তদারক করতে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ। যান বিএনপির ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি মির্জা আব্বাস। কিন্তু রাতভর চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয় উদ্ধার অভিযান। ভোররাতে হতাশার কথা শুনিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। চলে যান দায়িত্বরত অন্য সংস্থার ঊর্ধ্বতনরাও।
সকাল থেকেই ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও সন্দেহ করতে থাকেন পুরো বিষয়টি ‘নাটক’। কেউ বলেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এই ঘটনা সৃষ্টি করা হয়েছে। আবার কেউ বলেন, বিরোধী জোটের একটি কর্মসূচি ঘিরে আলোচনা ভিন্ন খাতে নিতে এটি সরকারেরই নাটক। দিনের বেলা অনেকটা ঢিলেঢালা উদ্ধার অভিযান চলতে থাকে। দুপুর আড়াইটার দিকে উদ্ধার অভিযান আনুষ্ঠানিক সমাপ্ত ঘোষণা করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান। তিনি এসময় বলেন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা, রেলওয়ের এক্সপার্টরা ওই কূপে কোন শিশুর অস্তিত্ব ও প্রাণের স্পন্দন পায়নি। এ জন্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হলো। এটি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তারা ওই পাইপটি পুরোটি উঠিয়ে দেখবেন যে, কোন শিশুর লাশ আছে কিনা। তিনি বলেন, স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় যে, ওই পাইপের ব্যাসার্ধ ১৮ ইঞ্চি। গভীরতা হচ্ছে ৪০০ ফুট। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করা। বশির নামে স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী পাইপের ভেতরে নামতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, কূপের ব্যাস অনেক সংকীর্ণ এবং গভীরতা অনেক, তাই সেখানে উদ্ধারকারী প্রবেশ করা অসম্ভব বলে তাকে নামতে দেয়া হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের শীর্ষ এই কর্মকর্তা বলেন, বড় পাইপটির ভেতরে একটি সরু পাইপ ছিল। সেটি তুলে আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়। পাইপের সঙ্গে পাম্পমেশিন সংযুক্ত ছিল। পাইপটি তুলে আনার সময় শিশুটি উঠে আসতে পারে ধারণা করা হয়। কিন্তু পাইপটি সম্পূর্ণ ওঠার পরেও ওই শিশুটি উপরে উঠে আসতে পারেনি।
আলী আহমদ খান বলেন, সর্বশেষ ওই কূপে একটি ক্যামেরা নামানো হয়। কিন্তু ওই ক্যামেরায় একটি সাদা পলিথিন, কাদামাটি ও পোকামাকড় দেখা যায়। দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমের অভিযানে ওই পাইপের ভেতরে কোন ভিকটিমের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ জন্য ওই অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। শিশুটি কূপের মধ্যে জুস খেয়েছে বা ডাকাডাকি করেছিল, উদ্ধারকাজের প্রথম দিকে ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের এমন দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভিকটিমের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় তথ্যকে বেশ